ঢাকা

আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক মৌলবাদী

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : ইং
ছবি: মিরর নিউজ ছবি: মিরর নিউজ

ইদানীং সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৌলবাদী, সংষ্কারবাদী, প্রগতিশীল, ধর্মীয় ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিস্ট শব্দগুলো নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক চলছে। আমি ভাবলাম, পর্যালোচনা করে দেখি আমি কোন শ্রেণিভুক্ত। তবে এটা অনেক জটিল ও প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। তারপরও হিসাব-নিকাশ করে দেখলাম- আমি নিসন্দেহে একজন মৌলবাদী। মৌলবাদী হলো তারা, যারা কঠোরভাবে মৌলিকত্বে বিশ্বাস করে।


এক সময় আমার মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না যে তা নয়। বহু বছর জ্ঞান সাধনা ও তপস্যা করে শেষ বয়সে এসেও আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না- আমি আসলে কী! বাংলাদেশে এলিট শ্রেণির কারো কারো বিশেষ কিছু অনন্য তকমা থাকে। কেউ হয়ত বুদ্ধিজীবী, কেউবা প্রগতিবাদী, অন্যরা আবার সুশীল শ্রেণিভুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি। আবার কেউ কেউ সবগুলো অর্থাৎ উদারপন্থি সুশীল শ্রেণিভুক্ত প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী। আমি ঠিক করতে পারছিলাম না আসলে আমি কোন শ্রেণিভুক্ত!

আমি ১৯৭৬ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আসছি। একজন ভালো গবেষক হিসেবে পরিচিতি আছে। আমার প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ১৪০টি। গোটা দশেক বই লিখেছি। ১৯৯৩ সাল থেকে শীর্ষস্থানীয় জাতীয় পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি অব্যাহত রেখেছি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ওষুধ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর একসময় নিয়মিত টক শো করেছি। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পৃথিবীর বহুদেশ ভ্রমণ করেছি। অনবদ্য গবেষণার জন্য বেশ কয়েকটি স্বর্ণপদকও পেয়েছি। আমার প্রাপ্তির শেষ নেই। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনেকেই মনে করেন আমি একজন মৌলবাদী। তার কারণ সম্ভবত আমি মনে প্রাণে একজন ধার্মিক মানুষ। আমি ধর্ম পালন করি, অন্যকেও ধর্ম পালনে উৎসাহিত করি বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও লেখালেখির মাধ্যমে। এই কাজটি আমি আমৃত্যু করে যাব ইন শা আল্লাহ। আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আমি মনে করি, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছে, সে ইহকাল পরকাল দুই কালই জয় করে নিয়েছে।

নিজকে মৌলবাদী ভাবতে আমার বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা হয় না। আসলে আমি শুধু শাব্দিক অর্থে নয়, মৌলিক অর্থে একজন মৌলবাদী। কিন্তু অনেকেই নিজকে মৌলবাদী ভাবতে কুণ্ঠাবোধ করে। নিজকে প্রগতিবাদী ও উদারপন্থী হিসেবে জাহির করার জন্য এরা ধর্মের সাথে কম্প্রোমাইজ করে। আধুনিক ও প্রগতিবাদী সাজার জন্য তারা ধর্মের কিছু অংশ মানে, কিছু অংশ পরিত্যাগ করে। যেমন করেছিলেন জার্মানিতে আমার এক তুরস্কের বন্ধু। যতদূর মনে পড়ে, সে মদ ও শুকরের গোস্ত খেত, আবার ধর্মকর্মও করতো কালে ভাদ্রে। ধর্মের অনেক কিছু এরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সনাতনী মনে করে এড়িয়ে চলে। আসল কথা হলো- ধর্ম মানাটা হল টোটাল প্যাকেজ অথবা ফিজিওলজির ভাষায় all-or-none law। মানলে সবটাই মানতে হবে, না হলে কিছুই নয়। এখানে মধ্যপন্থা বলে কিছু নেই। হয় আস্তিক, নয় নাস্তিক। ধর্ম না মানার স্বাধীনতাকে ইসলাম ধর্ম স্বীকার করে।

আমাকে জার্মানিতে একাধিক পার্টিতে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমি কেন শুকরের মাংস এবং বিয়ার বা ওয়াইন খাই না। আমি বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কে না গিয়ে সরাসরি বলেছিলাম- শুকরের মাংস ও মদ খেতে আল্লাহ কোরআনে নিষেধ করেছেন, তাই খাই না। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন মনে মনে ভেবেছিল- আমি তালেবান মার্কা একজন গোঁড়া ধর্মান্ধ মৌলবাদী। আবার অনেক জার্মান বন্ধু আমার উত্তরের প্রশংসা করেছিলেন। তাঁরা বলতেন, আমার চলনে, বলনে, কথাবার্তায় আমাকে ধর্মান্ধ বলে মনে হয় না। তাঁদের মতে, আমি একজন উচ্চ শিক্ষিত পারফেক্ট জেন্টেলম্যান। তা ছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের বহু মানুষ মদ ও শুকরের মাংস খায় না।

বাংলাদেশসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে নারীপুরুষের অবাদ মেলামেশা, মদ ও শুকরের মাংস না খাওয়ার জন্য মুসলমানদের ঢালাওভাবে চরমপন্থী ও মৌলবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অনেকে আমাকেও তাই মনে করত এবং এখনো করে। বেশ কয়েক বছর আগে তথাকথিত এক প্রগতিবাদী ও উদারপন্থী বন্ধু কোনো এক আলোচনা সভায় পরোক্ষভাবে আমাকে মৌলবাদী মনে করে আকারে ইঙ্গিতে একটা ছোটখাট বক্তব্য ঝেড়ে দিল। 

আমি হাসলাম, আমার ভালো লাগলো, একটুও খারাপ লাগলো না। বরং গর্ববোধ করলাম। কারণ আমি মৌলিকত্বে বিশ্বাস করি, ধর্ম ও আমার বিশ্বাস নিয়ে আপোস বা ভণ্ডামি করি না। ঘুষ, সুদ,  হারাম, শুকর ও মদ খাওয়া তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মের প্রতি নাক সিটকানো, ভুয়া চেতনাধারী, সাম্প্রদায়িক প্রগতিবাদী ও সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী আমি নই। আমি ডানপন্থী নই, আমি বামপন্থী নই, আমি ইসলামপন্থী। আমি ভালো করেই জানি, উদারপন্থী, প্রগতিশীল, প্রগতিবাদী, বুদ্ধিজীবী,সুশীল শব্দগুলো এদেশে মিডিয়া সিনথেসিস করে। তাই মৌলবাদীরা কোনোকালেই সুশীল, প্রগতিবাদী ও বুদ্ধিজীবী হয় না।

আমি ধর্মের বিধিবিধান মেনে চলি বা মেনে চলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। আমি চিন্তা ও কর্মে দ্বিমুখী নীতিতে বিশ্বাসী নই। আমি সব ধর্ম, মত ও পথের প্রতি সহনশীল সৎ, নিষ্ঠাবান ও ধর্মপরায়ন একজন মুসলমান। আমি এমন নই যে, ধর্মের একাংশ মানবো, অন্য অংশ বর্জন করব। তাই কেউ আমাকে মৌলবাদী বললে আমার মনে হয় আমি একজন খাঁটি মুসলমান। তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি প্রগতিবাদী, বুদ্ধিজীবী বা সুশীল হওয়ার জন্য নিজের বিবেকের সাথে ভণ্ডামি করতে প্রস্তুত নই।

লেখক, মুনিরুদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ,

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বিরুলিয়া, ঢাকা


আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক মৌলবাদী



কমেন্ট বক্স