
গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে ১৪ মাস পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে সরকার কতটা প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে—তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক, নারী অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
বিদেশ সফর ও ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন
এই সময়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৩টি দেশে ১৪ বার সফর করেছেন। কিন্তু এসব সফর থেকে বাংলাদেশ কী অর্জন করেছে, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। বিশেষ করে তাঁর সাম্প্রতিক রোম সফর নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকের মতে, এটি ছিল না কোনো দ্বিপাক্ষিক সফর, ফলে অর্জনের দিক থেকে তা তেমন ফলপ্রসূ নয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার বহুপাক্ষিক অনুষ্ঠানে যাওয়া জরুরি ছিল কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন আছে। এই সময়ের মধ্যে তাঁর আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ছিল।”
উপদেষ্টাদের সম্পদ বিবরণ না দেওয়া
দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিয়ে উপদেষ্টাদের সম্পদ বিবরণ প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু ১৪ মাসেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “এটা শেখ হাসিনার আমলের প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি। বর্তমান সরকার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি।”
তবে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহমেদ বলেন, “অনেক উপদেষ্টা ইতিমধ্যে সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। বাকিরাও দেবেন বলে আশা করছি।”
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ
অভ্যুত্থানের পর থেকেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিই বেশি আলোচিত হয়েছে। ‘মবসন্ত্রাস’-এর বেশ কিছু ঘটনাও দেশজুড়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। রাজবাড়ির গোয়ালন্দে ‘নুরাল পাগলা’ নামের এক ব্যক্তির মরদেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনাও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী অপরাধের হার স্থিতিশীল থাকলেও বিশ্লেষকদের মতে, প্রকৃত পরিস্থিতি তার বিপরীত। সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা তেমন উন্নত হয়নি। পুলিশের মনোবল ফেরাতে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।”
বিচার বিভাগে আস্থাহীনতা
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীরা। সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, “আইনের শাসন নেই। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জামিনের বিষয়ে মন্তব্য করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন।”
অন্যদিকে আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা বলেন, “সংস্কারের আশা ছিল, কিন্তু এখন বিচার বিভাগ প্রায় ভেঙে পড়েছে।”
ক্রীড়া উপদেষ্টাকে ঘিরে বিতর্ক
স্থানীয় সরকার ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নানা বিতর্কে রয়েছেন। তাঁর সহকারীর দুর্নীতি, অডিও ফাঁস, বিসিবি নির্বাচন নিয়ে অভিযোগসহ নানা কারণে তিনি সমালোচনায় আছেন।
সাংবাদিক মোজাম্মেল হক চঞ্চল বলেন, “তিনি ক্রীড়াঙ্গনকে কলঙ্কমুক্ত করতে এসে আরও জটিল করেছেন। বিসিবি নির্বাচন দেশের ক্রিকেটের ক্ষতি করেছে।”
ভিসা সংকট ও কূটনীতি
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সময়কালে অনেক দেশই বাংলাদেশের পাসপোর্টে ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। ভারত, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি দেশ এখনো কঠোর অবস্থানে আছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে বিদেশে।”
পরিবেশ ও দখল সমস্যা
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের উদ্যোগেও দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “দখল আগের চেয়ে বেড়েছে। পলিথিন উৎপাদন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।”
সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থা
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ দেশের সড়ক পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে বলে জানিয়েছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। “সংস্কার নেই, নতুন পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না,” বলেন তিনি।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও সাংবাদিক নির্যাতন ও চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা বা সহিংসতার মামলা চলমান। সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, “এই পরিস্থিতি সংবাদমাধ্যমের জন্য লজ্জাজনক।”
অর্থনীতি ও বিনিয়োগ
বর্ধিত দ্রব্যমূল্য, বিনিয়োগের স্থবিরতা এবং কর্মসংস্থানের সংকটে অর্থনীতি চাপে রয়েছে। ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন রুলেন বলেন, “বিদেশি ক্রেতারা নির্বাচনের পরের সরকার দেখার অপেক্ষায় আছেন। নতুন বিনিয়োগ আসছে না।”
আন্তর্জাতিক চাপ
ছয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছে সরকারকে। তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, “মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের কাজ করছে, সরকারও নিজের মতো কাজ করছে।”