
পৃথিবীতে এমন একসময় আসবে যখন অন্যায়, অবিচার, দাজ্জালীয় প্রতারণা ও মিথ্যা মতবাদ পৃথিবীকে গ্রাস করবে। ধর্মের নামে বিভ্রান্তি, রাজনীতির নামে নিপীড়ন, বিজ্ঞানের নামে নৈতিক অবক্ষয়—সব কিছু মিলিয়ে মানুষ হতাশার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হবে। ঠিক তখনই মহান আল্লাহর নির্দেশে আসমান থেকে অবতীর্ণ হবেন ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ.)।
তিনি কোনো নতুন শরিয়ত নিয়ে আসবেন না; বরং মুহাম্মদ (সা.)-এর আনীত চূড়ান্ত শরিয়তের অনুসারী হয়ে, পৃথিবীকে ন্যায় ও শান্তির রাজ্যে রূপ দেবেন।
এই আগমনের কথা শুধু হাদিস নয়, বরং পবিত্র কোরআনেরও ইঙ্গিত রয়েছে:
وَإِنَّهُ لَعِلْمٌ لِّلسَّاعَةِ
‘আর নিশ্চয় ঈসা (আ.) কিয়ামতের নিশ্চিত নিদর্শন।’ (সুরা : যুখরুফ, আয়াত: ৬১)
এই রাসুলুল্লাহ (সা.) মানবজাতিকে জানিয়ে গিয়েছেন যে, যে যুগে ঈসা (আ.) অবতীর্ণ হবেন, সেটি হবে সত্য ও মিথ্যার চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের যুগ। হাদিসটি হচ্ছে-
عَنْ أَبى هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُولِ اللهِ قَالَ لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَنْزِلَ فِيكُمْ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا مُقْسِطًا فَيَكْسِرَ الصَّلِيبَ وَيَقْتُلَ الْخِنْزِيرَ وَيَضَعَ الْجِزْيَةَ وَيَفِيضَ الْمَالُ حَتَّى لاَ يَقْبَلَهُ أَحَدٌ
আবু হুরাইরাহ (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইবনে মারইয়াম [ঈসা (আ.)] তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচারক হয়ে অবতরণ না করা পর্যন্ত কিয়ামত হবে না। তিনি এসে ক্রুশ ভেঙে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন এবং জিজিয়া কর তুলে দেবেন।
তখন ধন-সম্পদের এত প্রাচুর্য হবে যে, তা গ্রহণ করার মতো কেউ থাকবে না। (বুখারি, হাদিস : ২৪৭৬)
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ব্যাখ্যাকারদের ব্যাখ্যা
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে ঈসা (আ.) কিয়ামতের পূর্বে আসমান থেকে জীবিত অবস্থায় অবতীর্ণ হবেন। তিনি নতুন কোনো শরিয়ত আনবেন না; বরং মুহাম্মাদ (সা.)-এর শরিয়তের অনুসারী হিসেবেই শাসন করবেন।’ (শরহ সহিহ মুসলিম, ইমাম নববী, খণ্ড ২, পৃ. ১৮৮)
তিনি আরো বলেন, তিনি ক্রুশ ভাঙবেন— অর্থাৎ খ্রিস্টীয় বিভ্রান্ত আকিদার অবসান ঘটাবেন; শূকর হত্যা করবেন— অর্থাৎ হারাম সংস্কৃতি ও অপবিত্রতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবেন; আর জিজিয়া কর তুলে দেবেন— অর্থাৎ পৃথিবীতে শুধু আল্লাহর দ্বিনই থাকবে বিজয়ী।
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজর আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘এই হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ঈসা (আ.) এখনো জীবিত এবং কিয়ামতের আগে তিনি অবতীর্ণ হবেন। এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সর্বসম্মত বিশ্বাস।’ (ফাতহুল বারী, খণ্ড ৬, পৃ. ৪৯০)
তিনি আরো ব্যাখ্যা করেন, ‘জিজিয়া কর তুলে দেওয়া মানে শুধু ইসলাম গ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকবে না। তখন ইসলাম এত শক্তিশালী হবে যে কেউ জোরে নয়, বরং নিজে থেকেই ঈমান আনবে।’
‘ধন-সম্পদের প্রাচুর্য’ মানে পৃথিবীতে এমন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে যে, আর কেউ দরিদ্র থাকবে না; সবাই তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত থাকবে।
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবি বলেন, ‘ঈসা (আ.)-এর অবতরণ মানবজাতির জন্য দ্বিতীয় এক ন্যায়বিচার যুগের সূচনা করবে। তখন কোনো ধর্মীয় মূর্তিপূজা বা ক্রুশ-সংস্কৃতি থাকবে না। তিনি মুহাম্মাদ (সা.)-এর শরিয়ত অনুসারে শাসন করবেন এবং ইসলামী আইন সর্বত্র বাস্তবায়ন করবেন।’ (আল-মুফহিম লিমা আশকালা মিন সহীহ মুসলিম, কুরতুবি, খণ্ড ১, পৃ. ৩৬৭)
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যা (রহ.) বলেন, ‘ঈসা (আ.)-এর পুনরাগমন কুরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তিনি মিথ্যা খ্রিস্টীয় ধারণা— যে ঈসা আল্লাহর পুত্র— বিনাশ করবেন, সে ধারণা সম্পূর্ণ মুছে যাবে। যখন তিনি নেমে আসবেন, তখন মানবসভ্যতা ভোগবাদে নিমজ্জিত থাকবে, আর তিনি ন্যায়বিচার ও ঈমানের পুনর্জাগরণ ঘটাবেন।’ (আল-হাদী আল-নববী, খণ্ড ১, পৃ. ৭৪৩)
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহ.) বলেন, ‘ঈসা (আ.)-এর অবতরণ মানব ইতিহাসের চূড়ান্ত প্রমাণ হবে যে, খ্রিস্টানদের বর্তমান আকিদা বাতিল। কারণ তিনি নিজেই এসে বলবেন, ‘আমি আল্লাহর দাস ও রাসুল।’ তখন খ্রিস্টানরা বুঝবে, তারা যাকে আল্লাহর পুত্র ভাবছিল, তিনিই ইসলামের সৈনিক।’ (আল-জওয়াবুস সহীহ, খণ্ড ২, পৃ. ১৫৪)
সারসংক্ষেপ
ঈসা (আ.) বর্তমানে জীবিত, আসমানে অবস্থান করছেন।
কিয়ামতের আগে তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন, ইসলামী শরিয়তের ন্যায় শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন।
তাঁর আমলে খ্রিস্ট ধর্মের ভ্রান্ত তত্ত্ব বিলুপ্ত হবে।
সমাজে এত ন্যায়বিচার ও প্রাচুর্য আসবে যে মানুষ দান নেওয়া পর্যন্ত লজ্জা করবে।
এরপর তিনি মদিনায় এসে রাসুল (সা.) -এর পাশে দাফন হবেন। যার জন্য ইতিমধ্যে কবরের জায়গা নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। (দলিল : তাবারানী, আল-মুজামুল আউসাত; হাকিম, আল-মুস্তাদরাক)