বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে বিদেশি ষড়যন্ত্র ও বিভাজনমূলক পরিকল্পনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ একটি কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ভারতসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশের রাজনীতিবিদ, এনজিও ও সংগঠন ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ এবং ‘পূর্ব তিমুর মডেল’-এর মতো একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের এই ১০ পৃষ্ঠার কার্যবিবরণী প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রেরণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে পার্বত্যাঞ্চল ঘিরে দেশি-বিদেশি তৎপরতার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা অংশ নেওয়া বৈঠকে এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
ভারতের ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ পরিকল্পনা
কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ভারতের ত্রিপুরার রাজপরিবারের প্রধান প্রদ্যোত বিক্রম মানিক্য দেব বর্মা বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা ও ত্রিপুরাকে একত্র করে ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে ত্রিপুরার অংশ এবং এখানকার জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে আলাদা হতে চায়।
পশ্চিমাদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের তৎপরতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক, বাম রাজনীতিক ও বিদেশি এনজিও পার্বত্য অঞ্চলে ‘পূর্ব তিমুর’ ও ‘দক্ষিণ সুদান’-এর মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে কার্যবিবরণীতে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই পশ্চিমা কয়েকটি দেশের ১৩ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তিন পার্বত্য জেলা সফর করেছেন।
অস্ত্র ও অস্থিতিশীলতা
রিপোর্টে বলা হয়, পার্বত্য এলাকার সন্ত্রাসীরা মিজোরাম ও মিয়ানমার থেকে অস্ত্র পাচ্ছে। সম্প্রতি ইউপিডিএফ (প্রসীত) গোষ্ঠীর জন্য আট হাজার রাউন্ড গুলির একটি চালান আটক করা হয়। খাগড়াছড়িতে সহিংসতা ছড়াতে “ধর্ষণ” সংক্রান্ত মিথ্যা গুজব ছড়ানো হয়েছিল বলেও এতে উল্লেখ আছে।
চাকমা সার্কেল চিফের উসকানি
কার্যবিবরণীতে চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তিনি উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পাহাড়ে উত্তেজনা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা সৃষ্টির ঘটনাও তার নেতৃত্বে ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
ভারতের উসকানি ও আন্তর্জাতিক প্রচারণা
ভারত ও মিয়ানমারের বিভিন্ন উপজাতীয় সংগঠন বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। দিল্লিতে অবস্থানরত ইউপিডিএফ সমর্থিত সুহাস চাকমা জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে “গণহত্যা”র অভিযোগ তুলেছেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
দেশি সহযোগীদের নাম
বিভিন্ন রাজনীতিক, শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মীর নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তারা বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নে পার্বত্যাঞ্চলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এর মধ্যে ইউল্যাবের শিক্ষক অলিউর রহমান, ফারজানা প্রভা, সুলতানা কামাল, খুশী কবির, গোলাম মাওলা রনি ও অধ্যাপক মেজবাহ কামালসহ কয়েকজনের নাম রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
সাবেক সচিব শফিউল আজিম মনে করেন, পার্বত্যাঞ্চল ঘিরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বহুদিন ধরেই চলেছে, এখন তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। তিনি বলেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়ে বসবাসকারী সব নাগরিকের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে উন্নয়নমূলক উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
রুলস অব বিজনেস থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব
কার্যবিবরণীতে আরো জানা যায়, একসময় পাহাড়ি একটি সংগঠন সরকারের কাছে তিন পার্বত্য জেলাকে “রুলস অব বিজনেস” থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন করেছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সেটি সংবিধানবিরোধী হিসেবে নাকচ করে দেয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে পাহাড়কে অশান্ত করার চেষ্টা আরও বাড়বে। তাই দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপ এখন জরুরি।