ঢাকা

কষ্টদায়ক প্রাণী হত্যার ইসলামের নীতিমালা ও সীমারেখা

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : ইং
ছবি সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত

ইসলাম পৃথিবীর সব প্রাণীর প্রতি সদয় আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। তবে যেসব প্রাণী মানুষকে কষ্ট দেয় এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ নষ্ট করে, সেসব প্রাণী দমন করার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও মানুষকে নির্মমতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে। নিম্নে কষ্টদায়ক প্রাণী হত্যার ব্যাপারে ইসলামের বিধান ও নির্দেশনা বর্ণনা করা হলো।

প্রাণীর প্রতি সদয় আচরণ

ইসলামের সাধারণ নির্দেশ হলো প্রাণীদের প্রতি সদয় আচরণ করা। মানুষ নিজের জীবনের মতো প্রাণিকুলের জীবনকে মূল্যবান মনে করবে। পবিত্র কোরআনের আয়াত থেকে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণশীল এমন জীব নেই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে এমন কোনো পাখি ওড়ে না, কিন্তু তারা তোমাদের মতো এক একটি উম্মত। (সুরা : আনআম, আয়াত : ৩৮)

বিনা প্রয়োজনে প্রাণী হত্যা নয়

ইসলামে বিনা প্রয়োজনে প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ। প্রয়োজনের ভেতর আছে মানুষের খাদ্য, চিকিৎসা ও পোশাকের প্রয়োজন পূরণ করা, ক্ষতিকর প্রাণী থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা ইত্যাদি। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রাণী হত্যা করা নিষেধ করেছেন; তবে সে কষ্ট দিলে ভিন্ন কথা।’ (আল মুজামুল কাবির, হাদিস : ১২৬৩৯)

বিনা প্রয়োজনে প্রাণী হত্যার পরিণতি

বিনা প্রয়োজনে কেউ কোনো প্রাণী হত্যা করলে পরকালে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। তাই সে প্রাণী যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অযথা কোনো চড়ুই পাখি হত্যা করবে, সে কিয়ামতের দিন ক্রন্দন করে বলবে, হে রব! নিশ্চয়ই অমুখ আমাকে অযথা হত্যা করেছে আর আমাকে কোনো কল্যাণে হত্যা করেনি।’(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৯৬৯৯)

কষ্টদায়ক প্রাণী হত্যা করা জায়েজ

যেসব প্রাণী মানুষকে কষ্ট দেয়, যা মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি করে তা হত্যা করা জায়েজ। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হারাম শরিফের ভেতরেও পাঁচটি অনিষ্টকারী প্রাণীকে মারা যায়—ইঁদুর, বিচ্ছু, কাক, চিল ও হিংস্র কুকুর।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৮৩৭)

আল্লামা সারাখসি (রহ.) বলেন, ‘এখানে পাঁচটি প্রাণীকে (হত্যা নিষিদ্ধ হওয়ার বিধান থেকে) পৃথক করা হয়েছে। কেননা এগুলোর অভ্যাস হলো কষ্ট দেওয়া। সুতরাং যেসব প্রাণীর স্বভাব হলো কষ্ট দেওয়া তা যদি এই পাঁচটির বিধানভুক্ত হবে, তা হত্যা করা নিষিদ্ধ হবে না।’ (আল মাবসুত : ৪/৯০)

কষ্টদায়ক প্রাণী হত্যার সময় করণীয়

যেসব প্রাণী মানুষকে কষ্ট দেয়, মানুষের জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করে, তা হত্যা করা জায়েজ আছে। তবে এসব প্রাণী হত্যা করার সময়ও কিছু বিষয় লক্ষ রাখা আবশ্যক। যেমন—

১. অতিরিক্ত কষ্ট না দেওয়া : শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) বলেন, ‘দুটি বিষয় আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে স্মরণ রেখেছি। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে দয়ার ফয়সালা রেখেছেন। তাই তোমরা যখন হত্যা করবে সুন্দরভাবে হত্যা করবে আর যখন জবাই করবে সুন্দরভাবে জবাই করবে আর তোমরা প্রত্যেকেই তোমাদের ছুরিতে শান দেবে, যাতে জন্তু স্বস্তি পায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৫৫)

২. ক্রোধের শিকার না হওয়া : কষ্টদায়ক প্রাণী হত্যার সময়ও মুমিন ক্রোধান্বিত হবে না, যেন তার দ্বারা অহেতুক প্রাণী হত্যার ঘটনা না ঘটে। হাদিসে এসেছে, ‘একবার এক পিঁপড়া এক নবীকে কামড় দিল। তখন তিনি পিঁপড়ার গ্রামকে জ্বালানোর নির্দেশ দিলেন। তখন আল্লাহ তাঁর কাছে ওহি পাঠালেন যে তোমাকে একটি পিঁপড়া কামড় দেওয়ার কারণে কি এমন এক উম্মতকে ধ্বংস করেছ যারা তাসবিহ পড়ছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৪১)

৩. কষ্ট না দিলে হত্যা নয় : কোনো কষ্টদায়ক প্রাণী যদি মানুষের কষ্টের কারণ না হয়, তবে তাকে হত্যা করা যাবে না। একইভাবে কষ্টদায়ক প্রাণীর কোনো প্রজাতি যদি কষ্টদায়ক না হয়, তবে তাকেও হত্যা করা যাবে না। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) চার প্রকার প্রাণী হত্যা করতে নিষেধ করেছেন—পিঁপড়া, মৌমাছি, হুদহুদ পাখি এবং চড়ুইসদৃশ বাজপাখি।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫২৬৭)

আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) বলেন, ‘পিঁপড়া হত্যা করা মাকরুহ, যদি কষ্ট না দেয়। কেননা প্রাণী হত্যা করা শুধু সৎ উদ্দেশ্যেই বৈধ। তাই যখন সে কষ্ট দেবে না, তাকে হত্যা করা যাবে না। উকুনের ব্যাপারটি ভিন্ন। সে কষ্ট প্রদান করুক বা না করুক, সর্বাবস্থায় হত্যা করা যাবে। কেননা, সে স্বভাবজাতভাবে কষ্টদায়ক। আটালির ব্যাপারটিও অনুরূপ।’ (মিনহাজুস সুলুক : ১/৪২৫)

৪. আগুনে পুড়িয়ে হত্যা নয় : কষ্টদায়ক প্রাণীকেও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হবে না। কেননা এতে প্রাণী অতিরিক্ত কষ্ট পায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা নবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। আমরা এমন একটি পিঁপড়ার গ্রাম অতিক্রম করলাম, যা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নবীজি (সা.) বললেন, কোনো মানুষের উচিত নয় আল্লাহর শাস্তি (আগুন) দ্বারা শাস্তি দেওয়া।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২৬৭৫)

৫. বন্দি করে হত্যা না করা : কষ্টদায়ক প্রাণীকেও বন্দি করে, অভুক্ত রেখে হত্যা করা নিষেধ। জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যেকোনো প্রাণীকে বন্দি করে রেখে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৫৯)

৬. সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করা : হানাফি মাজহাবের প্রায় সব ফতোয়ার কিতাবে লেখা হয়েছে, ‘ক্ষতিকারক প্রাণীকে মারার জন্য এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যা তার জন্য কম কষ্টদায়ক হয় এবং তুলনামূলক সহজ হয়। বিনা প্রয়োজনে অধিক কষ্ট দেওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।’ (আলমুহিতুল বুরহানি : ৮/৯৪; ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া : ১৮/২২৪)

আল্লাহ সবাইকে সঠিক দ্বিন পালনের তাওফিক দিন। আমিন।




কমেন্ট বক্স