ঢাকা

অনৈক্য রেখেই কাজ শেষ ঐকমত্য কমিশনের

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : ইং
ছবি : সংগৃহীত ছবি : সংগৃহীত

রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে নয় মাস ধরে আলোচনায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত মতভেদ রেখেই কাজ শেষ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে কমিশনের কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়।

সুপারিশ অনুযায়ী, সনদ বাস্তবায়নে তিন ধাপের প্রক্রিয়া অনুসরণের প্রস্তাব করা হয়েছে—সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ জারি, গণভোট আয়োজন, এবং পরবর্তী জাতীয় সংসদকে একইসঙ্গে সংসদ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের ভূমিকা দেওয়া। তবে এই প্রস্তাবগুলো নিয়েই কমিশনের ভেতরে ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে।

ভিন্নমত ও বিতর্ক

সংবিধান সংস্কারের সাংবিধানিক আদেশ জারি করবেন রাষ্ট্রপতি নাকি প্রধান উপদেষ্টা—এই প্রশ্নে ঐকমত্য হয়নি। গণভোটের সময় নিয়েও বিভাজন রয়ে গেছে। বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হতে হবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চাইছে, ভোটের আগেই গণভোট সম্পন্ন হোক।

উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্বে (পিআর পদ্ধতি) নিয়েও ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকারপ্রধান হতে পারবেন কি না, গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ এবং সংসদীয় ক্ষমতা বণ্টন নিয়ে বিএনপি কমিশনের প্রস্তাবে লিখিত আপত্তি দিয়েছে। দলটি আগামী সংসদকে সাংবিধানিক পরিষদের ভূমিকা দেওয়ার প্রস্তাবেও অসম্মতি জানিয়েছে।

কমিশনের প্রস্তাব

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার আদেশ জারি করার পর থেকে জাতীয় নির্বাচনের দিন পর্যন্ত যেকোনো সময় গণভোট আয়োজন করতে পারবে। সংসদের প্রথম ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন না হলে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্যই গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সরকার ও নির্বাচন কমিশনের।”

সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়নে কমিশন দুটি বিকল্প পথের কথা বলেছে। এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, খসড়া বিল আকারে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব গণভোটে দেওয়া হবে। গণভোটে অনুমোদন পেলে সংসদ তা কার্যকর করবে। অপর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন না করলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

সুপারিশ প্রকাশের পর বিএনপি অভিযোগ করেছে, কমিশন ঐকমত্য নয়, বরং বিভাজন তৈরির কাজ করেছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ঐকমত্যের বদলে তারা অনৈক্য তৈরি করেছে, এজন্য তাদের ধন্যবাদ।”

গুলশানে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হতে হবে, এর বাইরে কোনো আলোচনা নেই।”

অন্যদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “যারা জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করতে চায়, তারা জুলাই সনদ অকার্যকর করতে চায়।”
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সতর্ক করে বলেছেন, “জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে কোনো দল এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে সংসদ ও সরকার টিকবে না।”

সনদ বাস্তবায়নের কাঠামো

কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী—

৯টি প্রস্তাব নির্বাহী আদেশে,

২৮টি অধ্যাদেশে,

এবং ৪৮টি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে।

সংবিধান সংশোধনের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও দায়িত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, বিচারবিভাগে সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন ও ন্যায়পাল নিয়োগ প্রক্রিয়া ইত্যাদি।

কমিশনের বক্তব্য

সংবাদ সম্মেলনে আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ ও কমিশন সদস্যদের মতামত মিলিয়ে এই সুপারিশ তৈরি করেছি। লক্ষ্য হলো জুলাই জাতীয় সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া এবং ভবিষ্যতের সংস্কার প্রক্রিয়ার রূপরেখা তৈরি করা।”

কমিশনের মেয়াদ আরও তিন দিন থাকলেও আশা প্রকাশ করা হয়েছে, সই না করা দলগুলো শেষ পর্যন্ত সনদে স্বাক্ষর করবে।



কমেন্ট বক্স